বাংলাদেশ-ভারত

লালমনিরহাট সীমান্তে মিলন মেলা, মন্দিরের পুরোহিত বাংলাদেশের ও পূজারী ভারতের

Posted on October 20, 2025 • 0 Views

লালমনিরহাট সীমান্তে মিলন মেলা, মন্দিরের পুরোহিত বাংলাদেশের ও পূজারী ভারতের
লালমনিরহাট সীমান্তে মিলন মেলা, মন্দিরের পুরোহিত বাংলাদেশের ও পূজারী ভারতের

সুজন কুমার রায়
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
দুই বোন একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন। সীমান্তের বাতাসে তখন যেন থমকে গিয়েছিল সময়। প্রায় দশ থেকে ১২ বছর পর আবার দেখা—বাংলাদেশের শুসিলা রানী (৬১) আর ভারতের নিয়তি রানী (৫২)।
লালমনিরহাটের দুর্গাপুর ও মোগলহাট সীমান্তে ধরলা নদীর পাড়ে ৯২৭ নম্বর সীমান্ত পিলারের কাছে রবিবার
(১৯ অক্টোবর) দিনভর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত মিলন মেলায় দেখা হয় তাদের। একে অপরকে দেখার পর আর কিছু বলার শক্তি ছিল না, কেবল কান্না। প্রায় দশ মিনিট ধরে চোখের জলেই যেন তারা বলে নিয়েছেন সব কথা।
বড় বোন শুসিলা রানী এনেছিলেন মিষ্টি, ইলিশ মাছ আর টাঙ্গাইলের শাড়ি। ছোট বোন নিয়তি রানী এনেছিলেন মিষ্টি, মসলা ও শাড়ি। উপহার বিনিময়ের সময়ও দুই বোনের চোখে অশ্রু ঝরেছে অনর্গল।
“দশ বারো বছর থাকি বোনের সাথে মোর দেখা স্বাক্ষাত নাই। মোবাইল ফোনে কথা হয় তাতে মন ভরে না। বুকটা ফেটে যায়। মিল মেলাত আসি বোনের দেখা পেয়া মনটা জুড়ি গ্যালো,’ বাংলাদেশের আদিতমারী উপজেলার দেওডোবা গ্রামের শুসিলা রানী।
অপরদিকে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানার গিদালদহ গ্রামের নিয়তি রানী বলেন, “ত্রিশ বছর আগোত হামরা রভারতে চলি আসি। মা-বাপ মরি গ্যাইছে। বাংলাদেশে খালি দিদি আছে। দশ বছর পর দিদির সাথে দ্যাখা হওয়াতে মনটা হালকা হয়া গ্যাইল।’
প্রতি বছরই ধরলা নদীপাড়ে সীমান্তের কোলঘেষে ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানার দড়িবাস এলাকায় শ্রীশ্রী মা বৃদ্ধেশ্বরী দেবীর পূজা উপলক্ষে বসে এই সীমান্ত মেলা। গত পঞ্চাশ বছর ধরে পূজা ও মিলন মেলা একসাথে চলছে এখানে।
এই পূজার বিশেষত্ব—মন্দিরের পুরোহিত আসেন বাংলাদেশ থেকে আর আর পূজারী ভারতের। দুই দেশের মানুষ একসাথে পূজা দেন, একসাথে প্রসাদ খান, আর একদিনের জন্য হলেও ভুলে যান সীমান্ত রেখার বিভাজন।
বাংলাদেশের পুরোহিত বিকাশ চন্দ্র চক্রবর্তী জানান, “প্রতি বছর হাজার হাজার ভক্ত আসেন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পূজা হয়। এই মন্দির প্রাঙ্গন হয়ে দুই দেশের ভক্তদের মিলন মেলা। অনেকে আসেন ভক্ত হিসেবে মন্দিরে পূজা করতে আবার অনেকে আসেন দর্শানর্থী হিসেবে।’
ভারতের পূজারী জ্যোতিষ চন্দ্র বর্মন বলেন, “পুরোহিত বাংলাদেশে, পূজারী ভারতে—এটা সম্প্রীতির প্রতীক। দুই দেশের ভক্তরা মিলেই এই মন্দির চালায়, আর্থিক সহযোগিতাও দু’দেশের মানুষই করে।” ‘রবিবার দিনভর পূজা উপলক্ষ্যে মিলন মেলায় বিশ হাজারের বেশি ভক্ত ও দর্শথনার্থী সমবেতন হন। বিকাল চারটা থেকে দর্শনার্থীরা বাড়িতে ফিরে যেতে শুরু করেন। কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি,’ তিনি বলেন।
মেলা ঘিরে দুই দেশেরই ভক্তরা আসেন নানা জায়গা থেকে। মন্দির প্রাঙ্গণে বসে খাবার, খেলনা, শাড়ি, গয়নার দোকান। সূর্যোদয়ের সঙ্গে শুরু হয় পূজা, সূর্যাস্তের আগে শেষ হয় সব আয়োজন। নিরাপত্তায় সতর্ক থাকে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী—বিজিবি ও বিএসএফ।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাটের প্রশান্ত সেন বলেন, “এ মেলায় হিন্দু-মুসলমান সবাই আসে। ভিসা বন্ধ থাকায় এখন এই মেলাই একমাত্র দেখা করার সুযোগ।”
মোগলহাট থেকে আসা দর্শথনার্থী জাহিদুল ইসলাম জানান, আমি প্রতিবছরই এই মেলায় আসি। আমাদের অনেক আত্মীয় ভারতে রয়েছেন। এই মেলায় এসে আত্মীয়দের সাথে দেখা করি এবং সংসারের কুশলাদি বিনিময় করি।’
রংপুরের গুপ্তপাড়া থেকে আসা সুধীর চন্দ্র গুপ্ত বলেন, “এক বছর ধরে ভারতে যেতে পারি নাই। এখানে এসে আত্মীয়দের বুকে জড়িয়ে ধরেছি। সীমান্তের এই মেলায় কাঁদে সবাই, কিন্তু সেই কান্নায় থাকে আনন্দের সুর। এটা শুধু আবেগ নয়, এটা সীমান্ত পেরোনো প্রেমের এক অফুরন্ত চিত্র।”
ভারতের কোচবিহার জেলার ভেটাগুড়ি থেকে আসা দর্শনার্থী ধীরেন্দ্র নাথ বর্মণ জানান,’ বাংলাদেশে অনেকে আত্মীয় স্বজন মেলায় এসেছিলেন। অনেকের সাথে দেখা হয়েছে। আমাকে জড়িয়ে অনেকে কেঁদেছেন, আমিও কেঁদেছি।’
ফটোকার্ড

Share this post